কন-শাস-নেস শেষ পর্ব

কন-শাস-নেস
শেষ পর্ব
" রহস্যই সর্বাতীত সৌন্দর্যের প্রতীক। সমস্ত বিজ্ঞান আর শিল্পকলার উৎস হচ্ছে রহস্য। এই অনুভূতিটি যার মধ্যে অনুপস্থিত, বুকভরা জীবন্ত রহস্যের সামনে দাড়িয়েও যার মন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায় না, ধরতে হবে তার মৃত্যু হয়েছে, তার মন আর চোখ দুয়েরই। "
- আইনস্টাইন
১।
রিলেটিভিটি যেমন আমাকে টানে, কোয়ান্টাম টানে, সেই একই মমতায় বায়োলজিও টানে। মহাবিশ্বের রহস্যগুলো আমরা একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি, যতই বুঝছি পিয়াজের খোসার মতো আরও, আরও রহস্য একটু একটু করে বের হচ্ছে। আমার কাছে, জীবন আর চেতনা এই দুটো জিনিস কোয়ান্টাম থিওরির চেয়ে কম রহস্যময় নয়। আমরা মহাবিশ্বকে যতটুকু জেনেছি, তার ধারেকাছেও জানতে পারি নি, ঠিক কিভাবে, কার্বন হাইড্রোজেন আর নাইট্রোজেনের এই নিথর দেহ চেতনা নামের এই অতি অস্বাভাবিক জিনিসের জন্ম দেয়।
প্রায় ১ মাস আগে, আজকের মতই এক রাতে কন-শাস-নেস লেখাটা শুরু করেছিলাম। আজকে শেষ করবো। যে অধির আগ্রহে ৫টা পর্ব জুরে একের পর এক প্রশ্ন করেছিলাম সেগুলোর বেশীরভাগই অজানা রয়ে যাবে। কন-শাস-নেসের আজও কোন সর্বসম্মত থিওরি নেই, তবে আস্তে আস্তে কিছু থিওরি দাড় হচ্ছে। বিজ্ঞানে একটা থিওরির টিকে থাকার মাপকাঠি হচ্ছে এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট। কনশাসনেসের জন্য এটাই হোল সবচেয়ে বড় বাঁধা।
গত পর্বে আমরা দেখেছিলাম ব্রেইনের নিউরাল নেটওয়ার্ক কিভাবে জটিল থেকে জটিলতর প্রবলেম সল্ভ করতে পারে। হিউম্যান ব্রেইনের আশ্চর্য অস্বাভাবিক প্রবলেম সল্ভিং পাওয়ার আছে, কোটি কোটি যোগ বিয়োগ গুন ভাগ সে প্রতি নিয়ত করে চলছে। কিন্তু তারপর? যোগ বিয়োগ গুন ভাগ এগুলো তো সব মেশিনও পারে। আমি সি. এস. ইর ছাত্র। নিউরাল নেটওয়ার্ক ছিল আমার আন্ডারগ্র্যাডের থিসিস টপিক। আমি জানি, মেশিনও শিখতে পারে, জটিল জটিল ডিসিশন নেওয়ার জন্য কনশাস হওয়ার প্রয়োজন পরে না।
দাবা খেলতে কনশাসনেস লাগে না।
সেকেন্ডে ১টা করে নিঃশ্বাস নিতে কনশাসনেস লাগে না।
ঠিক কোন জায়গায় ব্যাকটেরিয়ারা বাসা বেঁধেছে, তাদেরকে মারার জন্য হোয়াইট ব্লাড সেল পাঠানো দরকার, এই ডিসিশন নিতেও কনশাসনেস লাগে না।
আমি সিরিয়াল কিলার। আমি তারপরও মানুষ। আমি জানি এক লোকটাকে হত্যা করলে ভয়াবহ একটা খারাপ কাজ হবে। আমার অনুভূতি দিয়ে আমি বুঝতে পারি মরার সময় তার খুব কষ্ট হবে। তারপরও আমি ডিসিশন নিলাম খুনটা করার।
এই ডিসিশন নিতে কনশাসনেসের আসলেই কি কোন প্রয়োজন আছে?
সম্ভবত, নেই। ৪র্থ পর্বে আমরা দেখেছি, আমরা এখন অনেকদূর মাইন্ড রিডিং শিখে গেছি। আপনি মনে মনে কি ভাবছেন ব্রেইনের প্যাটার্ন আনালাইজ করে বলে দেওয়া যায়। ড্যানিয়েল সি ডেনেটের কনশাসনেস এক্সপ্লেইন্ড বইতে একটা এখপেরিমেন্টের কথা বলা হয়েছে, যেখানে সাবজেক্টকে ২টা ইমেজ থেকে চুজ করতে দেওয়া হয়। সে যদি ডানের ইমেজটা চুজ করে, ডান বাটন প্রেস করবে, ডানে লাইট জ্বলবে, নাহলে বাম বাটন প্রেস করবে, বামে লাইট জ্বলবে। তার মাথায় একটা হেলমেট মরানো ছিল, ব্রেইনের প্যাটার্ন বুঝার জন্য।
সাবজেক্ট জানত না, কোন লাইট জ্বলবে সেটা তার বাটন প্রেসের জন্য আসলে বসে নেই, ব্রেইন থেকে সরাসরি ডিসিশন নিচ্ছে।
এই এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল ছিল, সাবজেক্ট হাত নড়ান শুরু করার অনেক আগেই ব্রেইনে ডিসিশন হয়ে যায় আসলে কি করা উচিত। সাবজেক্ট খুব সম্ভব ডিসিশন হয়ে যাওয়ার পর ফিডব্যাক টুকু পায়, এইযে তুমি ডানের ছবিটা চুজ করেছো, এটা কিন্তু তোমার ডিসিশন, এটা জাস্ট কিছু ম্যাথম্যাটিক্যাল এনালাইসিস নয়, আসলেই একজন মানুষ আছে এর পিছনে।
ডিসিশন নিতে যদি কনশাসনেস না লাগে, তাহলে কনশাসনেসের কাজটা কি? পুরো দুনিয়া যদি অন্ধকার হয়ে যেত আপনার আমার কাছে, আর চারপাশে ঘুরে বেড়াতো মানুষরূপী জম্বিরা, কিছু কি যায় আসত? আরও বড় কথা, আপনি কিভাবে বুঝতেন কে মানুষ যে জম্বি?
২।
ডিভাইড অ্যান্ড কনকুয়ার কম্পিউটার সাইন্সের একটা বড় ফিলসফি। গিউলিও টনোনি, ক্রিস্টফ কচ মোটামুটি সিম্পল কিছু যুক্তির উপর ভিত্তি করে ২০০৪ সালে কনশাসনেসের ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন থিওরি IIT ডেভলপ শুরু করেন, ডেভলপমেন্ট এখনো চলছে। এই থিওরি কনশাসনেসের একমাত্র থিওরি নয়, তবে থিওরিটা আমার কাছে প্রমিজিং মনে হয়েছে, আস্তে আস্তে আরও ডেভলপ করবে। এই থিওরি বলেঃ
$ কনশাসনেস ইলিউশন হতেও পারে, তবে যদি ভর আধান এইসব জিনিস সত্যি হয়, কনশাসনেসও সত্যি।
$ যেহেতু কনশাস ডিসিশন গুলো, চিন্তাগুলো, চোখে দেখা রঙগুলো, অনুভূতিগুলো, সব ম্যাপ হয় কর্টেক্সে, কনশাসনেস থাকে কর্টেক্সে।
$ যেহেতু ডান ব্রেইন বাম ব্রেইন ২ টুকরো হোলে কনশাসনেস ২ টুকরো হয় (৪র্থ পর্ব), যেহেতু ভিসুয়াল কর্টেক্স নষ্ট হোলে মানুষ দেখার অনুভূতি হারায় (পর্ব ৩), এবং আরও অনেক ড্যামেজে কনশাসনেস টুকরো হয়, তাই কনশাসনেস আসলে অনেক কনশাসনেসের সমষ্টি।
$ যেহেতু ঘুমিয়ে গেলে যদি আমরা স্বপ্ন না দেখি, তখন ব্রেইনের প্যাটার্ন দেখে বলে দেওয়া যায় যে কর্টেক্সের কনশাস অংশগুলো তখন এক্সাইটেড হয় না, তাই কনশাসনেসের বিভিন্ন লেভেল আছে। ঘুমিয়ে গেলে লেভেল নিচে চলে যায়, কোমায় গেলে লেভেল আরও নেমে যায়, মৃত মানুষের কনশাসনেস শূন্য। কোন রোগী কোমা থেকে ব্যাক করবে, আর কে পুরোপুরি এ ব্যাপারে IIT খুব ভালো প্রেডিকশন করতে পারে।
$ ২ টা কনশাস সিস্টেমকে এক করতে হোলে দরকার ফিডব্যাক লুপ টাইপ স্ট্রাকচার। ২টা কনশাস সিস্টেম যদি এমনভাবে কানেক্টেড হয় যে তাদেরকে আর কোন সরল সিস্টেম দ্বারা রিপ্লেস করা যায় না তবে তাদেরকে irriducible সিস্টেম বলে। সিস্টেমের irriduciblity পরিমাপ করার একক হোল ফাই (গ্রিক অক্ষর বড় হাতের ফাই) । প্রচুর ফিডব্যাক লুপ বিশিষ্ট একটা irriducible সিস্টেমের ফাই অনেক। কর্টেক্সে এরকম প্রচুর লুপ থাকে, অন্য অংশে থাকে না।
$ যে সিস্টেমের ফাই তত বেশি সে তত বেশি অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারে। লাল রঙ দেখার সিস্টেম আর নীল রঙ দেখার সিস্টেম এক হয়ে লাল-নীল রঙ দেখার irriducible সিস্টেম তৈরি করে। এভাবে অসংখ্য সিস্টেম এক হয়ে ব্রেইন হয়েছে।
$ শুধু irriducible সিস্টেম হলেই হবে না, তার অংশগুলোর ইনপুট আউটপুট কি হবে তার উপরও কনশাসনেস নির্ভর করে। ঘুমিয়ে গেলে সিস্টেমের কনশাসনেস কমে যায়। সিস্টেমের অংশগুলোর স্টেট ডিফারেন্স কি রকম তার উপর কনশাসনেস নির্ভর করে।
$ যতই ভাঙব ততই কনশাসনেস আরও বেশি হারে কমবে। ২টা সিস্টেমের মিলিত ফাই, তার কম্পোনেন্টগুলোর ফাইএর সমষ্টির চেয়েও যদি বেশি হয়, তবেই ওই ২ সিস্টেম মিলে নতুন irriducible কনশাস সিস্টেম তৈরি করবে। এই নতুন কনশাসনেস তখন ওই দুই কনশাসনেসকে ওভাররাইড করবে। এভাবে কর্টেক্স বাকি ব্রেইনকে আর ব্রেইন পুরো শরীরকে ওভাররাইড করে।
$ যার কনশাসনেস যত কম সে তত বেশি ঘুমন্ত। তত বেশি মেশিন টাইপের। মশা, মানুষের তুলনায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাকটেরিয়া আরও বেশি।
$ খুব কম হলেও, সবাই কনশাস। একটা পরমাণু কনশাস। একটা ইলেকট্রন কনশাস।
$ IIT মতে, কনশাসনেস ফান্ডামেন্টাল জিনিস। সফটওয়্যার দিয়ে যেমন ভর সিমুলেট করলেই আসলে ভর হয়ে গেলো না, তেমনি একটা AI প্রোগ্রাম কনশাস নয়। CPU র ফাই খুবি কম, সে লিনিয়ার মেশিন। সে মশার চেয়েও কম কনশাস।
$ IIT মতে, আপনার ৮৬ বিলিয়ন নিউরন যদি ৮৬ বিলিয়ন মেকানিক্যাল নিউরন দিয়ে রিপ্লেস করা হয়, এবং তাদের স্টেট মেইন্টেইন করা হয়, তবে আপনি কনশাসনেস হারাবেন না।
৩।
IIT র অনেক বিষয়, যেমন কনশাসনেস কোথায় থাকে, তাকে যে ভাগ করা যায় এগুলো মোটামুটি পরিক্ষিত বিষয়। কনশাসনেসের শুরু আসলে কোথায় এ ব্যাপারে IIT মোটামুটি অনুমান নির্ভর, আরও অনেক পরীক্ষার বাকি আছে। ফিডব্যাক লুপের সাথে কনশাসনেসের সম্পর্ক কোনভাবেই ইগ্নর করা যায় না, ফিডব্যাক লুপগুলো নির্দিষ্টভাবে কানেক্টেড হলে কনশাসনেস বৃদ্ধি পায় এটাও ঠিক কনশাসনেস থাকার জন্য শুধু এই লুপ থাকলেই চলে কিনা সেটা প্রশ্নের ব্যাপার। চললেও, এটাও হতে পারে, IIT অনেক টাইপের কনশাসনেসের মধ্যে শুধু একটাকে ডেস্ক্রাইব করে আসছে।
আপনার যখন মৃত্যু হবে, কর্টেক্সের কোষগুলো একটা একটা করে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে, তখন আপনার কনশাসনেস কই যাবে? বিজ্ঞান বলে, কেউ যদি সযত্নে আপনার প্রতিটা কোষের স্টেট, অবস্থানসহ সবকিছু অন্য কোন ব্রেইনের মতো ধারকে সেভ করে না রাখে কনশাসনেস হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো।
আর যদি কোন মেকানিক্যাল নিউরনের তৈরি ব্রেইনে আপনার ৮৬ বিলিয়ন নিউরনের সবগুলো স্টেট সেভ করে রাখা যায়, তবে আপনাকে আবার বাঁচিয়ে তোলা যাবে।
ভালো থাকবেন।
(সমাপ্ত)
(collected)

Image may contain: indoor